728x90 AdSpace

Latest News

Saturday, 9 November 2019

রূপকথার গ্রাম হুলহুলিয়া

রূপকথার গ্রাম হুলহুলিয়া

সাইফুল ইসলাম, সিংড়া (নাটোর)

এ যেন এক রূপকথার গ্রাম। নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। নেই ঝগড়া-বিবাদ। নেই কোনো রাজনৈতিক বিরোধ। এমনকি স্বাধীনতার পর এ গ্রামের কেউ কখনও মামলা করতে থানায় যায়নি। সুখে-দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকেন গ্রামের সবাই। বিস্ময়কর এ গ্রামের নাম হুলহুলিয়া। এটি নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত।

নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শান্ত গ্রাম হুলহুলিয়া। ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলনবিল বেষ্টিত গ্রামটির আয়তন গ্রায় দুই বর্গকিলোমিটার।

গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক প্রামাণিকসহ অন্যরা জানান, এখানে শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। শীতে এ গ্রামে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। কিন্তু পাখি মারার প্রবণতা নেই গ্রামবাসীর। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বশাসন ব্যবস্থা চলে আসছে এখানে। এ গ্রামে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, মাদক ব্যবসা নেই। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। এর প্রতিফলন দেখা যায় এ গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা মেধাবীদের পরিসংখ্যানে। গ্রামের দেড় শতাধিক সন্তান প্রকৌশলী, শতাধিক চিকিৎসক। আছেন কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও।

জানা গেছে, ১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। গ্রামের অনেক চাষী ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তারা বিনাশর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের উন্নয়নে ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠিত হয়। বিষয়টি জানান, বর্তমানে পরিষদের সহসভাপতি মো. আলমগীর কবীর শাহ।

তিনি জানান, এই পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’ পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন সভাপতি, একজন সহসভাপতি ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এছাড়া ৫ জন উপদেষ্টা থাকেন। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে। বড় কোনো অপরাধ সংগঠিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর করে। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়ায় প্রথম উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। শুরুতে শিক্ষকদের অনেকেই বিনা বেতনে বা অর্ধেক বেতনে শিক্ষাদান করেন। পরে এখানে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালনায় দুটি স্কুলও চলছে। চলনবিলবেষ্টিত হওয়ায় আগে বর্ষা মৌসুমে নৌকাই ছিল গ্রামটির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে পরিষদের চেষ্টায় এখন সারা বছর সড়কপথেও যাওয়া যায় এই গ্রামে।

এই গ্রামে ১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।

একটা সময় এই গ্রামে কোনো কবরস্থান ছিল না। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কেউ মারা গেলে পুকুরপাড় ও কোনো উঁচু স্থানে তাকে কবর দেয়া হতো। পরিষদের চেষ্টায় প্রায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি স্থায়ী কবরস্থান করা হয়েছে। কবরস্থানের দেখভালের জন্য আছে ছয় সদস্যের একটি কমিটি।

আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে নিজেদের মেধা, অর্থ ও শ্রম দিয়ে গেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যে- শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, মরহুম মফিজ উদ্দিন, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ, আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক মরহুম হানিফ উদ্দিন মিঞা, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম একে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এমএম রহমত উল্লাহ প্রমুখ। হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ বলেন, পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রেখে সবাই মিলেমিশে গ্রামে সুশিক্ষা, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনই আমাদের মূল লক্ষ্য। চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল ইসলাম ভোলা বলেন, পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে।

সিংড়া থানার ওসি (তদন্ত) নেয়ামুল হক বলেন, থানার পরিসংখ্যানই বলে, হুলহুলিয়া গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। জমিজমা নিয়ে বিরোধ হলেও গ্রামের পরিষদই তা সমাধান করে।

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, হুলহুলিয়া গ্রাম দেশের আর দশটা গ্রাম থেকে অনেকটা আলাদা। এই গ্রামের মানুষ সামাজিক বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

© JUGANTOR.COM
  • Blogger Comments
  • Facebook Comments

0 Comments:

Post a Comment

Item Reviewed: রূপকথার গ্রাম হুলহুলিয়া Description: Rating: 5 Reviewed By: COMPLETE BCS
Scroll to Top